আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের বিমা খাত উন্নত নয় এবং দেশের অর্থনীতিতে এ খাত খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বিমা খাতের অবদান খুবই নগণ্য।
তবে এটাও ঠিক যে বাংলাদেশের বিমা খাত খুবই সম্ভাবনাময়। এ সম্ভাবনাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে আমাদের চিন্তা করার সময় হয়েছে। সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত পেশাদারি শিক্ষায় জনবল তৈরিতে।
বলা হয়ে থাকে, যে দেশের মানুষ যত শিক্ষিত, সে দেশের মানুষ তত উন্নত। দেশের বিমা খাতের উন্নয়নের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ বিমা খাতের উন্নয়নে প্রথম পদক্ষেপই হতে হবে পেশাদারি শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি করা।
বিমা কোম্পানিগুলো মূলত ঝুঁকি গ্রহণ করে। তা হলো আমাদের জীবন ও সম্পদের অনিশ্চয়তার ঝুঁকি। আকস্মিক বিপদে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কিনে নেওয়াই বিমা কোম্পানির ব্যবসা। ফলে ঝুঁকি গ্রহণের আগে বিমা কোম্পানিকে ঝুঁকির আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করতে হয়। একে আমরা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বলি, যা আসলে একটি বিশেষায়িত কারিগরি শিক্ষা। এ ছাড়া বিমা পলিসির অবলেখন, হিসাব গণনা, দাবি, পুনর্বিমার মতো বিষয়গুলো বিশেষায়িত কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে এটাই প্রচলিত।
দেশে বিমা খাত নিয়ে নেতিবাচক ধারণা বা আস্থাহীনতার কথা আমরা জানি। এ নিয়ে বেশি আলোচনা করার কিছু নেই। তবে এর নেপথ্য বা মূল কারণ হিসেবে বিমা খাতের পেশাদার ও শিক্ষিত জনবলের অভাবকেই প্রধানত দায়ী বলে আমি মনে করি।
পেশাদার ও শিক্ষিত জনবল না থাকায় বিমা কোম্পানিগুলোকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। এ কারণে সঠিকভাবে বিমা পলিসি যেমন হচ্ছে না, তেমনি দাবি পরিশোধও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ছে। ফলে গ্রাহকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং বিমাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা।
দেশের বিমা খাতে পেশাদার শিক্ষিত জনবল তৈরি না হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো কোম্পানিগুলোতে চাকরির সুযোগ-সুবিধার অভাব। পেশাদারি শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা এ খাতে নেই। যাঁরা বেশি প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেন, তাঁদেরই বেশি আর্থিক সুযোগ দেয় বিমা কোম্পানিগুলো। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বা কারিগরি শিক্ষা—কোনোটিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে পেশাদারি শিক্ষিত জনবল গড়ে ওঠেনি। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পেশাদারি শিক্ষা ছাড়া বিমা খাতে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
বিমা পেশায় পেশাদারি শিক্ষাগুলো কী কী বিষয়ে হয়ে থাকে, তা এবার বলা যাক। জীবনবিমা কোম্পানির দায় মূল্যায়ন করেন অ্যাকচ্যুয়ারি। অথচ দেশে এখন অ্যাকচ্যুয়ারি আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। আবার সাধারণ বিমা (নন-লাইফ) কোম্পানির ক্ষেত্রে সনদপ্রাপ্ত (চার্টার্ড) ইনস্যুরার রয়েছেন মাত্র ছয়-সাতজন। তবে আশার কথা যে অ্যাকচ্যুয়ারি তৈরিতে সরকার বৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। ইতিমধ্যে দুজন ছাত্রকে অ্যাকচুয়ারি পড়তে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।
আমি মনে করি, বিমা পেশায় উচ্চশিক্ষিত জনবল তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি বিমা কোম্পানিগুলোরও এগিয়ে আসা উচিত। সেই সঙ্গে বর্তমানে যাঁরা এসিআইআই, এফসিআইআই, এলএমএফআই ডিগ্রিধারী আছেন, তাঁদের শীর্ষ পদে চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা রাখা উচিত।
দক্ষ জনবল তৈরির আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে সুষ্ঠু প্রশিক্ষণ। এ ব্যাপারে বিমা কোম্পানিকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে। মোদ্দাকথা হলো দক্ষ জনবল তৈরিতে বিমাশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। পরিশেষে, কাল (আজ) বুধবার অনুষ্ঠেয় জাতীয় বিমা দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিমাশিক্ষার বিষয়ে ঘোষণা আশা করছি।